সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদক : শব্দ দূষণে দুর্বিষহ জীবনের হালচাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে শব্দ দূষণ এক নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। শব্দ দূষণ এখন জীবনবিনাশী ‘শব্দ সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত। দূর্বিষহ করে তুলেছেন জনজীবন। শব্দ দূষণের উত্সগুলো আপনার আমার সবার নাগালের মধ্যে। যেমন, বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানসহ নানা সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইকে গান বাজানো যেন একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শব্দ দূষণ রোধে আমি আপনিই বা কেন প্রতিবাদ করব? দেশে তো আইন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। দেশে শব্দ দূষণ প্রতিরোধে আইন থাকলেও তার তেমন কোনো প্রয়োগ নেই বললেই চলে। কিন্তু এর পরিণতি যে ভয়াবহ তা আমরা একবারও কানে তুলছি না। এক গবেষণায় জানা গেছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। পরিসংখ্যানটি ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও দেশের সবার জন্যই তা অমঙ্গলজনক এক বার্তা বহন করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। ফলে শব্দ দূষণকারীরা যেমন আইনের তোয়াক্কা করছেন না, তেমনি অসচেতনরা প্রতিনিয়ত শব্দকে দূষণ করে জনজীবনকে বিষিয়ে তুলছেন। ভুক্তভোগী মানুষগুলো এর ফল সঙ্গে সঙ্গে না পেলেও এর পরিণাম যে সুদূরপ্রসারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না বলে আমি মনে করি।
আমাদের দেশে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ অর্থাত্ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশবাদীদের প্রায়ই আন্দোলন, মিটিং-মিছিল করতে দেখা যায়। লেখকদের এ নিয়ে পাতা পাতা লেখাও চোখে পড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। তাহলে উদ্যোগগুলো কীভাবে কাজে আসতে পারে? আসল কথা হলো, সরকারের যদি একান্ত সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে আমার আপনার ও পরিবেশবাদীদের শত চেষ্টা এবং প্রচারণা কোনো কাজে আসবে না। দেশে সবকিছু নিয়েই কম-বেশি আইন আছে। তবে এগুলোর ব্যবহার কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? কেউই আইনের সুফল ভোগ করছেন না।
আমরা আন্দোলন করি, দাবি-দাওয়া শুধু সরকারের কানে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু তা শব্দ দূষণের ভিড়ে গিয়ে সরকারের কানে পৌঁছায় কি? যদি পৌঁছে থাকে, তাহলে আমি ক্ষুদ্র কণ্ঠ দিয়ে বলতে চাই- বিশ্বের অন্যান্য দেশে শব্দ দূষণ রোধ করা সম্ভব হলে আমাদের দেশে কেন রোধ করা যাবে না? আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, প্রয়োজন শুধু কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা।
শব্দ দূষণের বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে আমরা সরকারি কোনো সংস্থার কার্যক্রম লক্ষ্য করি না। তাদের আশায় বসেও থাকতে পারেন না সচেতন মহল। বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ সম্প্রতি ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছেন। ঢাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। ঢাকায় সাধারণভাবে যানবাহন ও হর্নের শব্দই শব্দ দূষণের মূল কারণ। তবে এর বাইরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা আরও কয়েকটি বড় কারণ। আজকাল প্রতিটি দিন শহরের কোথাও না কোথাও উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে মাইক কিংবা সাউন্ড বক্সে গান বাজাতে শোনা যায়। কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষ লাগে না, স্থানীয় লোকজন দোকানপাট কিংবা বাসার ছাদে তীব্র শব্দে গান-বাজনা ছেড়ে দেয়। এছাড়া শহরে প্রয়োজনীয় কাজে যারা মাইক ব্যবহার করেন, তারা কেউই সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে শব্দের মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ সৃষ্টি করে শব্দ দূষণ করেন। এতে যেমন আপামর সবার সমস্যা হয়, তেমনি সচেতনরা বিরক্ত বোধ করেন। মোটের ওপর অধিকাংশ লোকজন শব্দ দূষণের কারণে অতিষ্ঠ সবসময়। এছাড়া যদি আমরা ঘরোয়া শব্দ দূষণের দিকটি বিবেচনায় নেই তাহলে টাইলস লাগানো, ড্রিলিং এগুলোর শব্দ তো আছেই।
এ কথা সত্য যে, আজকাল সর্বত্র শব্দ দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো আমাদের তাড়া করে ফিরছে। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ আজ সেখানে নষ্ট হচ্ছে। কেননা, উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হূদরোগ, আলসার হওয়ার কারণে এসব থেকে মুক্তি পেতে ডাক্তারের কাছে ঢালতে হচ্ছে অপরিমেয় টাকা। চিকিত্সার জন্য যেতে হচ্ছে বিদেশে। শব্দ দূষণের কারণে মেজাজ খিটমিটে ও বিরক্ত হওয়া স্বাবাবিক ঘটনা তো মাত্র। শব্দ দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু এবং বয়স্করা। আমি একজন তরুণ হয়েও শব্দ দূষণজনিত পীড়ায় ভুগছি। মন দিতে পারছি না পাঠে। যদিও শব্দ দূষণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগকে বিঘ্ন করছে, তবুও হাট-বাজার ও মিল-কারখানা সংলগ্ন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এর বিপরীতটাও বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিরোধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ দেখছি না।
আমি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে মনে করি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শব্দ দূষণের প্রভাব বেশ স্পর্শকাতর। যেমন, মায়ের গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দ দূষণের কবলে পরে ক্ষতির শিকার হতে পারে। অর্থাত্ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া শিশুদের বেড়ে ওঠায় বাধাগ্রস্ত হয় এবং গর্ভবতী নারীদের বিকলাঙ্গ বা মৃত সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর আমাদের নিজেদের কথা কী বলব, ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে আমাদের শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে, হূদযন্ত্রের কম্পন ও রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে, হজমক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে ও মাংসপেশিতে খিঁচুনি হচ্ছে। আগে জানতেন, শব্দ দূষণে শুধু মেজাজ খিটখিটে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয়। আজ জানলেন অন্য কিছু। বুঝতে তো পারছেন, অসুস্থরা এই শব্দ দূষণের শিকার হয়ে কতটা যন্ত্রণায় আছেন।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ঢাকায় যে হারে শব্দদূষণ হচ্ছে, তা যদি কোনোক্রমে অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। আমরা জানি, শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা বা মানমাত্রা ৬০ ডেসিবেল, সেখানে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। তাহলে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবে কে? আমরা ঢাকাবাসী যারা আছি, তারা কি শব্দ সন্ত্রাস বন্ধ করণে কোনো উদ্যোগই নিতে পারি না? আমরা কি নিজেরা একটু সচেতন হতে পারি না? প্রশ্ন রেখে গেলাম নগর পিতাদের কাছে। প্রশ্ন রেখে গেলাম ভুক্তভোগী ও শব্দ দূষণ সৃষ্টিকারী সবার কাছে।
শব্দ এক প্রকার শক্তি। এই শক্তি আমরা দৈন্দদিন কাজে ব্যবহার করি। কিন্তু এই শক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা অপব্যবহার করে বসি। অযথা শব্দের মাত্রা বাড়িয়ে শব্দ দূষণ করি। শব্দ ব্যবহারে শব্দের মানমাত্রার পরিমাণ আমাদের জানা দরকার। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলা ৬৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, শিল্পাঞ্চলে দিনের বেলা ৭৫ ডেসিবেল, রাতের বেলা ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনের বেলা ৫০, রাতের বেলা ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। তাই আমরা প্রতিদিন এসব স্থানে কত মাত্রার শব্দ তৈরি করছি, তা অবগত থাকা দরকার। এর জন্য সবার শব্দের তীব্রতা মাপার জন্য ‘অডিওমিটার’ যন্ত্রের সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জনগণকে আগ্রহী করে তুলতে হবে যে তারা অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি করছে কি-না। যদি শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম হয়, তাহলে শব্দ দূষণ রোধকরণে তাগিদ দিতে হবে। প্রচারমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। শব্দ দূষণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো যত্নসহকারে পত্রিকায় ছাপানোর মাধ্যমে জনগণের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছাতে হবে। এছাড়া আরও নানা কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এর জন্য প্রথমত সরকারের আন্তরিকতা খুবই দরকার। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে শব্দ দূষণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আমি মনে করি।